আয়োনীয় পথিক পিথাগোরাসকে আমরা কে না চিনি। বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ জর্জ সাটনের ভাষায় পিথাগোরাস হলেন সর্বযুগের গণিতের অভিভাবক। পিথাগোরাস ইতালির ক্রোতনায় এলে এক তরুণী পিথাগোরাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ইতালির ক্রোতনা শহরে। পিথাগোরাসের চেয়ে ৩০ বছরের ছোট এই তরুণীর নাম ছিল থিয়ানো। তাঁকে পিথাগোরীয় সংঘ বা পাঠশালার সবচেয়ে প্রতিভাধর শিষ্যদের একজন বলে সবাই মানত। ধারণা করা হয়, পরে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন কন্যা ও দুই ছেলে ছিল বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, থিয়ানো ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, পদার্থবিদ, চিকিত্সাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও দক্ষ প্রশাসক।
পিথাগোরাসের জন্ম গ্রিসের স্যামোস দ্বীপে। বিশুদ্ধ গণিতের জন্মদাতা তিনিই। ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বে পিথাগোরাস দক্ষিণ ইতালির দোরিয়ান উপনিবেশের অন্তর্গত ক্রোতনা শহরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি দর্শন ও গণিতশাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা দিতেন। তাঁর বক্তৃতাকক্ষ সব সময় উত্সাহীদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত। তখনকার সময়ে সাধারণ সভায় নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকলেও পিথাগোরাসের সভায় নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। থিয়ানো এখানে এসে পিথাগোরাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
পিথাগোরাসের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থিয়ানো পিথাগোরীয় সংঘ বা পাঠশালা চালানোর দায়িত্ব নেন। থিয়ানোর তিন কন্যা এরিগনট, মারিয়া, ডেমো পিথাগোরাসের পাঠশালা থেকেই গণিত শিখেছিলেন। তাঁরা দার্শনিকও ছিলেন। ডেমো (৫৩৫-৪৭৫) তাঁর বাবার ‘ট্রিটিস অন জিওমেট্রি’ প্রকাশে সহায়তা করেন। থিয়ানো এবং তাঁর তিন কন্যার প্রচেষ্টায় এ পাঠশালার কার্যক্রম গ্রিসের সীমানা পেরিয়ে মিসর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাস বলে, থিয়ানোই হলেন প্রথম নারী গণিতবিদ, যাঁর গণিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।
পিথাগোরাস যে ভ্রাতৃসংঘ তৈরি করেছিলেন, তা উত্সর্গ করেছিলেন দর্শন ও গণিতের প্রতি। এই পাঠশালায় থিয়ানো ও পিথাগোরাসের দেখা হতো। দুজনের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। একসঙ্গে আলোচনা করতেন গণিত ও দর্শন নিয়ে। থিয়ানোর মা ও বাবা ছিলেন পিথাগোরাসের সহযোগী। বাবা ছিলেন ব্রনটিনাস। পেশায় একজন চিকিত্সক। মা পিথোন্যাক্স। থিয়ানোর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হচ্ছে গণিতে সুবর্ণ গড় (Golden Mean)। এটা স্থাপত্য ও শিল্পকলায় ব্যবহার করা হয়। থিয়ানোর পরে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল দর্শনে সুবর্ণ মধ্যক ধারণার অবতারণা করেন। পিথাগোরাসের জীবনী ছাড়াও থিয়ানো রচনা করেন phythgorean Apophthegms, Female Advice, On the Virtue, On Piety, On Pythagoras, Philosophical Commentaries, Letters। দুর্ভাগ্যবশত এসব কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ে কোনো ব্যক্তিগত বস্তুগত সম্পদ ছিল না। যেকোনো কাজ বা গবেষণা ব্যক্তিসম্পদ নয়, সামষ্টিক প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা হতো।
পিথাগোরীয় নেতৃত্বের প্রতি যখন প্রতিবিপ্লব হলো, এক সজীব শস্যখেতের সামনে গভীর চিন্তায় মগ্ন পিথাগোরাসকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই সময় পিথাগোরীয় সংঘের ভার থিয়ানোই তুলে নিলেন। তিন কন্যার সহায়তায় গণিতের ধারণা, পিথাগোরীয় জ্ঞান এবং মতবাদগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। পিথাগোরাসের মৃত্যুর পর পিথাগোরীয় গাণিতিক জ্ঞান, মতবাদ, চিন্তাধারাগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে থিয়ানোই কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অনেকে বলে থাকেন পিথাগোরাসের পরবর্তীকালে দার্শনিক ও গণিতবিদদের ওপর এত প্রবল প্রভাব থিয়ানো ছাড়া সম্ভব ছিল না। ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, চিকিত্সাবিজ্ঞান সর্বত্রই নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। থিয়ানো সম্পর্কে আমাদের এই তথ্যাবলি সে ধারণাকেই শক্তিশালী করল।
0 Comments