মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (Mariana Trench) পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্রখাত হিসেবে পরিচিত। এটি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত, মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২০০ কিলোমিটার পূর্বে। এই খাতটি একটি অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ গড়ে ৬৯ কিলোমিটার। এর গভীরতম স্থান, যা "চ্যালেঞ্জার ডিপ" নামে পরিচিত, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,৯৮৪ মিটার (৩৬,০৩৭ ফুট) নিচে অবস্থিত। কিছু পরিমাপে এটি ১১,০৩৪ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
উৎপত্তি ও গঠন
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সৃষ্টি হয়েছে ভূত্বকের টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট এবং ফিলিপাইন প্লেটের মধ্যে অধোগমন (subduction) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত। প্রশান্ত প্লেটটি ফিলিপাইন প্লেটের নিচে ঢুকে যাওয়ায় এই গভীর খাদের জন্ম হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের মতো দ্বীপচাপও তৈরি হয়েছে।
নামকরণ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নাম এসেছে কাছাকাছি অবস্থিত মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ থেকে। এই দ্বীপগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল ১৭শ শতাব্দীতে স্পেনের রানী মারিয়ানার সম্মানে, যিনি ছিলেন রাজা চতুর্থ ফিলিপের স্ত্রী। ১৬৬৭ সালে স্পেনীয়রা এই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং রানীর নামে দ্বীপগুলোকে "লাস মারিয়ানাস" নামকরণ করে।
পরিবেশ ও বৈশিষ্ট্য
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম অংশে পরিবেশ অত্যন্ত চরম। এখানে:
- চাপ: পানির চাপ ১,০৮৬ বার (১৫,৭৫০ পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চি), যা সমুদ্রপৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১,০০০ গুণেরও বেশি। এই চাপে পানির ঘনত্ব প্রায় ৫% বেড়ে যায়।
- তাপমাত্রা: ১ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৪ থেকে ৩৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
- আলো: সূর্যের আলো ১,০০০ মিটারের বেশি গভীরে পৌঁছায় না, তাই এর তলদেশ সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত।
জীববৈচিত্র্য
এত প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও মারিয়ানা ট্রেঞ্চে জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। গবেষকরা এখানে মনোথ্যালামিয়া নামে এককোষী জীব, অ্যাম্ফিপড, হলোথুরিয়ানসহ বিভিন্ন অণুজীব আবিষ্কার করেছেন। এই প্রাণীরা চরম চাপ, ঠান্ডা ও অন্ধকারে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত।
মানব অভিযান
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম অংশে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন। এখন পর্যন্ত:
- প্রথম অভিযান: ১৯৬০ সালে সুইস ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক পিকার্ড এবং মার্কিন সমুদ্রবিজ্ঞানী ডন ওয়ালশ "ট্রিয়েস্ট" নামক বাথিস্ক্যাফে চ্যালেঞ্জার ডিপে পৌঁছান। তারা ৩৫,৮১৪ ফুট (১০,৯১৬ মিটার) গভীরতা রেকর্ড করেন।
- দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য অভিযান: ২০১২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরন এককভাবে ১০,৯০৮ মিটার গভীরতায় পৌঁছান।
- রেকর্ড: ২০১৯ সালে ভিক্টর ভেসকোভো ১০,৯২৭ মিটার গভীরতায় পৌঁছে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েন। তিনি সেখানে প্লাস্টিক দূষণের চিহ্নও খুঁজে পান।
২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২২টি মানবচালিত এবং ৭টি মানববিহীন অভিযান সম্পন্ন হয়েছে।
গুরুত্ব
- বৈজ্ঞানিক গবেষণা: এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম অবস্থা ও জীবনের উৎপত্তি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- পরিবেশগত তাৎপর্য: ২০০৯ সালে মারিয়ানা ট্রেঞ্চকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা এর সংরক্ষণ নিশ্চিত করে।
- ভূতাত্ত্বিক গবেষণা: এর পাথর ও মাটি ভূমিকম্প এবং টেকটোনিক কার্যকলাপ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
রহস্য ও চ্যালেঞ্জ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এখনো অনেকাংশে অজানা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও এর পুরো গভীরতা ও রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর তলদেশে আরও অনেক অজানা প্রাণী ও ভৌগোলিক বিস্ময় লুকিয়ে আছে।
এই খাতটি শুধু পৃথিবীর গভীরতম স্থানই নয়, বরং মানুষের কৌতূহল ও বিজ্ঞানের সীমা পরীক্ষার একটি প্রতীকও।
0 Comments